হাদিস হলো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কথা, কাজ এবং তাঁর অনুমোদন। এটি কোরআনের পর ইসলামের দ্বিতীয় প্রধান উৎস এবং মুমিনের জীবন পরিচালনার জন্য এক উজ্জ্বল পথনির্দেশ। হাদিসের আলোকে একজন মুমিনের জীবন কেমন হওয়া উচিত, তা এখানে আলোচনা করা হলো।
১. বিশ্বাস ও কর্মের মধ্যে গভীর সম্পর্ক
হাদিস আমাদের শেখায় যে, ঈমান শুধু মুখে উচ্চারণের বিষয় নয়, বরং তা অন্তরের বিশ্বাস এবং সে অনুযায়ী কর্মের প্রতিফলন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “ঈমান হলো ৭০-এর বেশি শাখার সমষ্টি। এর সর্বোচ্চ শাখা হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা এবং সর্বনিম্ন শাখা হলো রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা।” (সহিহ মুসলিম) এই হাদিস প্রমাণ করে যে, একজন মুমিনের ঈমান তার আমল বা কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত।
২. উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতা
মুমিনের জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো উত্তম চরিত্র। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে সুন্দর।” (সহিহ বুখারী) মুমিন কখনও মিথ্যা বলে না, গীবত করে না এবং ওয়াদা ভঙ্গ করে না। সে সত্যবাদী, বিনয়ী এবং সকলের প্রতি দয়ালু হয়।
৩. আল্লাহর ওপর ভরসা ও কৃতজ্ঞতা
হাদিস আমাদের শেখায় যে, মুমিন সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর ভরসা করে (তাওয়াক্কুল) এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বিপদ-আপদে সে হতাশ হয় না, বরং ধৈর্য ধারণ করে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “মুমিনের বিষয়টি কতই না বিস্ময়কর! তার সবকিছুই কল্যাণকর। যদি সে সুখ-শান্তিতে থাকে, সে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে, আর এটা তার জন্য কল্যাণকর। যদি সে কষ্টে থাকে, সে ধৈর্য ধারণ করে, আর এটা তার জন্য কল্যাণকর।” (সহিহ মুসলিম)
৪. জ্ঞান অর্জন ও সমাজসেবা
ইসলামে জ্ঞান অর্জনের ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ।” (ইবনে মাজাহ) একজন মুমিন শুধু নিজের ধর্মীয় জ্ঞানই বৃদ্ধি করে না, বরং সমাজের কল্যাণের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানও অর্জন করে। সে শুধু নিজের জীবন নিয়েই ব্যস্ত থাকে না, বরং মানুষের উপকারে আসে এবং সমাজকে উন্নত করার চেষ্টা করে।
৫. দয়া ও সহমর্মিতা
মুমিনরা একে অপরের প্রতি দয়ালু ও সহানুভূতিশীল হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “মুমিনরা একে অপরের জন্য এমন, যেমন একটি ইমারত, যার একটি অংশ অন্য অংশকে শক্ত করে ধরে রাখে।” (সহিহ বুখারী) মুমিনরা একজন আরেকজনের বিপদে পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকে না।
৬. মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি
হাদিস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, পার্থিব জীবন ক্ষণস্থায়ী। একজন মুমিন তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে এমনভাবে ব্যবহার করে, যেন সে পরকালের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “তোমরা এমনভাবে দুনিয়াতে বাস করো, যেন তোমরা একজন অপরিচিত অথবা একজন পথচারী।” (সহিহ বুখারী) এই হাদিস আমাদের শেখায় যে, আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য হলো পরকালের সফলতা অর্জন করা।
হাদিসের এই শিক্ষাগুলো আমাদের জীবনকে এক অর্থপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল পথে পরিচালিত করে। এটি কেবল ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং আমাদের চরিত্র গঠন, সামাজিক আচরণ এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য এক পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন।