ইসলামিক প্রশ্ন উত্তর হজ্জ

হজ্জ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ, তাৎপর্য ও আদায়ের নিয়মাবলী

Written by Jahangir

হজ্জ হলো ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এটি আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হলেও পালন করা ফরজ। হজ্জ মূলত আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অসাধারণ মাধ্যম এবং বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতির প্রতীক।

হজ্জের গুরুত্ব

হজ্জের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি শুধু একটি ইবাদত নয়, বরং এর রয়েছে গভীর আধ্যাত্মিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য।

  • আল্লাহর আদেশ পালন: হজ্জ আল্লাহর আদেশ। এটি পালনের মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি তার আনুগত্য ও ভালোবাসা প্রকাশ করে।
  • গুনাহ থেকে মুক্তি: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্জ পালন করে এবং কোনো অশ্লীল বা পাপ কাজে লিপ্ত হয় না, সে তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে।” (সহিহ বুখারী ও মুসলিম)
  • ঐতিহাসিক শিক্ষা: হজ্জের প্রতিটি ধাপের সাথে ইসলামের মহান ইতিহাস জড়িয়ে আছে। যেমন: ইব্রাহিম (আ.), ইসমাইল (আ.) এবং হাজেরা (আ.)-এর ত্যাগ ও সংগ্রামের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে।
  • বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব: হজ্জের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা একই স্থানে, একই পোশাকে একত্রিত হয়। এর ফলে জাতি, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মাঝে এক অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব ও সংহতি সৃষ্টি হয়।

হজ্জ পালনের নিয়মাবলী

হজ্জের মূল কাজগুলো হলো ইহরাম, তাওয়াফ, সা’ঈ, আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, কোরবানি, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা, এবং জামারাতে পাথর নিক্ষেপ। হজ্জ মূলত তিন প্রকার: হজ্জে ইফরাদ, হজ্জে তামাত্তু এবং হজ্জে ক্বিরান। অধিকাংশ বাংলাদেশী হাজি হজ্জে তামাত্তু পালন করেন, যা উমরা ও হজ্জের সম্মিলিত রূপ।

হজ্জের ধাপগুলো নিচে বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো:

১. ইহরাম: হজ্জের প্রথম ধাপ হলো ইহরাম বাঁধা। এটি হলো হজ্জের নিয়ত করে বিশেষ ধরনের সেলাইবিহীন সাদা কাপড় পরিধান করা। মিকাত (নির্দিষ্ট স্থান) থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। ইহরাম অবস্থায় কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়, যেমন: চুল বা নখ কাটা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, শিকার করা, এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা।

২. তাওয়াফ: কাবা ঘরের চারপাশে সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলে। ইহরাম বাঁধার পর মক্কায় পৌঁছে প্রথমে উমরার তাওয়াফ করতে হয়।

৩. সা’ঈ: সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার দৌড়ানোকে সা’ঈ বলে। এটি হাজেরা (আ.)-এর পানির সন্ধানের স্মৃতি বহন করে।

৪. আরাফাতের ময়দানে অবস্থান: হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আরাফাতের ময়দানে অবস্থান। ৯ই যিলহজ্জ তারিখে সূর্য উদয়ের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজ্জের মূল ফরজ। এখানে দোয়া, জিকির ও আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফের জন্য প্রার্থনা করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আরাফাতে অবস্থান করাই হজ্জ।” (সুনান তিরমিজি)

৫. মুযদালিফায় রাত্রিযাপন: আরাফাত থেকে ফিরে মুযদালিফায় রাত কাটানো সুন্নাত। এখান থেকে জামারায় পাথর নিক্ষেপের জন্য ছোট ছোট কঙ্কর সংগ্রহ করা হয়।

৬. জামারাতে পাথর নিক্ষেপ: ১০ই যিলহজ্জ তারিখে মিনায় অবস্থিত জামারাতুল আকাবায় সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হয়। এই দিনে বড় শয়তানকে পাথর মারা হয়। এরপর কোরবানি, মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা এবং তাওয়াফে যিয়ারত (হজ্জের মূল তাওয়াফ) সম্পন্ন করতে হয়।

৭. কোরবানি: ১০ই যিলহজ্জ তারিখে কোরবানি করা ওয়াজিব। এটি ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগের স্মৃতি বহন করে।

৮. তাওয়াফে যিয়ারত ও সা’ঈ: কোরবানি ও মাথা মুণ্ডনের পর মক্কায় এসে কাবা শরীফের তাওয়াফ ও সা’ঈ সম্পন্ন করা হয়।

৯. আইয়ামে তাশরিক (১১, ১২ ও ১৩ই যিলহজ্জ): এই দিনগুলোতে মিনায় অবস্থান করে শয়তানকে পাথর মারা হয় এবং আল্লাহর জিকির করা হয়।

হজ্জের এই নিয়মগুলো সঠিক ও পরিপূর্ণভাবে পালনের মাধ্যমে একজন মুমিন ব্যক্তি তার জীবনের এক মহত্তম ইবাদত সম্পন্ন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে এগিয়ে যায়। হজ্জ একটি কঠিন কিন্তু অত্যন্ত ফলপ্রসূ সফর, যা একজন মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনকে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা দেয়।

About the author

Jahangir

নাম: আবু আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর। একজন ইসলামিক ব্লগার। আমি ”ইসলামের দাওয়াত” ব্লগে নিয়মিত কুরআন-হাদিসের আলোকে ব্লগ প্রকাশ করে যাচ্ছি।

Leave a Comment